তাফসীর

ঐশী আতিথ্যের মাস-রমজান : ২০১৩ (৭ পর্ব)

শুভাকাঙ্খী হওয়া একটা ভালো গুণ, সৎগুণ। কল্যাণকামিতা ইসলামের একটি অন্যতম শিক্ষা। এটা পরনিন্দার ঠিক বিপরীত। পরনিন্দা চর্চা যে রহমত প্রাপ্তির অন্তরায়, সে বিষয়ে গত আসরে আমরা খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। এ ব্যাপারে সামান্য সচেতনতাও যদি এসে থাকে আপনাদের মনে তাহলেই আমাদের লক্ষ্য অর্জিত হবে। আজকের আসরে আমরা আরো কিছু অসৎ প্রবণতার কথা বলার চেষ্টা করবো,যেসব প্রবণতার মধ্যে রমযান মাসের অসামান্য রহমত থেকে আমাদের বঞ্চিত হবার শঙ্কা রয়েছে।
পরনিন্দার মতো আত্মঘাতী প্রবণতার পথ ধরে হিংসা এবং পরশ্রীকাতরতার অশুভ প্রবণতাটি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অপরের সম্পর্কে জানার এক অদম্য কৌতূহল জেগে ওঠে মনের গভীরে। ছিদ্রান্বেষী হয়ে ওঠে মন। পেছনে লেগে থেকে থেকে কিংবা কাউকে পেছনে লাগিয়ে রেখে কোনো ত্রুটি খুঁজে পেলে তো যুদ্ধ জয় হয়েই গেল,কিন্তু যদি কিছুই খুঁজে পাওয়া না যায়-তবেই দাঁড়ায় মহাবিপদ।

শুভাকাঙ্খী হওয়া একটা ভালো গুণ, সৎগুণ। কল্যাণকামিতা ইসলামের একটি অন্যতম শিক্ষা। এটা পরনিন্দার ঠিক বিপরীত। পরনিন্দা চর্চা যে রহমত প্রাপ্তির অন্তরায়, সে বিষয়ে গত আসরে আমরা খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। এ ব্যাপারে সামান্য সচেতনতাও যদি এসে থাকে আপনাদের মনে তাহলেই আমাদের লক্ষ্য অর্জিত হবে। আজকের আসরে আমরা আরো কিছু অসৎ প্রবণতার কথা বলার চেষ্টা করবো,যেসব প্রবণতার মধ্যে রমযান মাসের অসামান্য রহমত থেকে আমাদের বঞ্চিত হবার শঙ্কা রয়েছে।
পরনিন্দার মতো আত্মঘাতী প্রবণতার পথ ধরে হিংসা এবং পরশ্রীকাতরতার অশুভ প্রবণতাটি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অপরের সম্পর্কে জানার এক অদম্য কৌতূহল জেগে ওঠে মনের গভীরে। ছিদ্রান্বেষী হয়ে ওঠে মন। পেছনে লেগে থেকে থেকে কিংবা কাউকে পেছনে লাগিয়ে রেখে কোনো ত্রুটি খুঁজে পেলে তো যুদ্ধ জয় হয়েই গেল,কিন্তু যদি কিছুই খুঁজে পাওয়া না যায়-তবেই দাঁড়ায় মহাবিপদ।

ভাবখানা এমন যেন ত্রুটি না থাকাটাই মস্ত বড়ো একটা ত্রুটি। এখন তাই ত্রুটি বানাতে হবে। মিষ্টির দোকানের গ্লাসে গুড় লাগানোর গল্পের মতো গল্প তৈরী করার কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে ছিদ্রান্বেষী দুষ্ট লোকটি। ছিদ্রান্বেষী মনের এই আগুন বড়ো সাংঘাতিক। এই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় জীবনের সকল অর্জিত সম্পদ। ছিদ্রান্বেষী মন নিজেকে যেমন জ্বালায় তেমনি জ্বালায় পরিপার্শ্বকেও। মনের ভেতরে ক্ষোভ,হিংসা, পরশ্রীকাতরতা জন্ম দেয় এই ছিদ্রান্বেষী প্রবণতা।

 

ইসলাম এই প্রবণতার প্রচণ্ড বিরোধী। ইসলাম অপরের দোষত্রুটি খুঁজে না বেড়িয়ে গুণগুলো দেখতে বলেছে। শুধু তাই নয় একমাত্র যুদ্ধ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করাকে ভীষণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। আমাদের মানবীয় দুর্বলতার কারণে এসব জেনেও আমরা অনেক সময় না জানার মতো কাজ করে বসি-যা কেবল আল্লাহর রহমত প্রাপ্তিরই অন্তরায় নয়,বরং আল্লাহর রোষানলে পড়ার শামিল। মানুষ যে পরচর্চা করে,তার পেছনেও রয়েছে হিংসা বা পরশ্রীকাতরতা। হিংসা হলো এক ধরণের আগুন,তুষের আগুন। মনের ভেতরে তুষের আগুনের মতো হিংসা জ্বলতে থাকে নিরবে নিভৃতে। কিছুতেই তা নিভতে চায় না। যে কারণে আগুন জ্বলে,সেই কারণটার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তা নেভে না। কেন জ্বলে এই আগুন?

হ্যাঁ! এটা এমনিতেই মনের একটা কু-প্রবণতা। পার্থিব জগতের শান-শওকত চিন্তা থেকে এবং পরকালীন চিন্তার অভাব থেকেই তার জন্ম হয়। মানুষ যদি ভাবতো এই পৃথিবীর কোনো কিছুই পরকালীন জীবনে কাজে আসবে না একমাত্র পুণ্যকাজগুলো ছাড়া,তাহলে আর অপরের ধন-সম্পদ দেখে কাতর হতো না। যেহেতু পরকালীন চিন্তা নেই সেহেতু অপরের ভালো,অপরের সুখ-শান্তি,অপরের বিত্ত-বৈভব দেখে সহ্য হয় না। কেবলই ভাবতে থাকে কীভাবে অপরের সেই সুখ-শান্তি নষ্ট করা যায়,কীভাবে তার বিত্ত-বৈভব ধ্বংস করে দেওয়া যায়। এই চিন্তাতেই তার দিন কাটে,রাত কাটে। ঘুম হয় না। হিংসুকের চোখ থেকে আল্লাহ ঘুম কেড়ে নেন। হিংসুকের মন থেকে আল্লাহ শান্তি কেড়ে নেন। হিংসুকের অন্তর থেকে শুভ বোধগুলো দূর হয়ে যায়। মুখ থেকে চলে যায় আস্বাদ-স্পৃহা,অরুচি কিংবা রুচিহীনতা দেখা দেয়। সম্পদ থাকতেও খাবার তৌফিক থাকে না। আর অশুভ চিন্তা, অন্যায় পরিকল্পনা মাথার ভেতর খেলতে থাকে সবসময়। মিথ্যাচার প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তখন। যার পরিণতি হয় ভয়াবহ।

 

হিংসা মানুষের সকল সদগুণ ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেয়, যেভাবে আগুন পুড়িয়ে ছাই করে দেয় আস্ত চেলাকাঠ। হিংসা যে কতো ভয়ঙ্কর একটি প্রবণতা তা বোঝা যাবে বাংলা একটি প্রবাদ থেকে। প্রবাদটি হলো “নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা।” একবার একটু গভীরভাবে ভেবে দেখুন তো,ঘটনাটা কী ভয়াবহ! নিজের লাভে নয় বরং অপরের ক্ষতি করার জন্যে নিজের জীবন দেওয়ার মতো ঘটনার কথাও শোনা যায়। কিন্তু কেন! কেন আমরা অপরের সুখে কষ্ট পাবো? কেন আমরা উদার হবো না ? ইসলাম তাই হিংসা বা পরশ্রীকাতরতাকে তীব্র ঘৃণার চোখে দেখে। মনের ভেতর হিংসা পুষে রেখে রমযান মাসে রোযা রাখলে তা কেবল উপোস করাই হবে,তা থেকে কোনোরকম রহমত প্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে হয় না। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেনঃ যারা আমার বান্দার নেয়ামত দেখে হিংসা করে তারা আমার বন্টন ব্যবস্থাকে অপছন্দ করছে।

কোরআনের এ আয়াত থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে যে,আল্লাহ যাকে যেরকম বিত্ত-বৈভব দিয়েছেন,তার ওপর সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আল্লাহর সৃষ্টিরহস্য আমাদের পক্ষে বোঝা কোনোদিনই সম্ভব নয়। তিনি সমাজে ধনী-গরীব সৃষ্টি করেছেন। কাউকে শারীরিক পূর্ণতা দিয়েছেন কাউকে অপূর্ণতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এ সবের ওপর মানুষের কোনোরকম হাত নেই। একইভাবে আল্লাহ মানুষদেরকে পরস্পর নির্ভরশীল করে সৃষ্টি করেছেন। কাউকে যদিও বিত্তশালী করেছেন,দেখা যায় সে-ই আবার অন্য কোনো বিষয়ে অপরের ওপর নির্ভরশীল। বিত্ত-বৈভবগত এই শ্রেণীবিন্যাসের রহস্য আল্লাহই ভালো জানেন। আমাদের উচিত সর্বাবস্থায় তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকা। এই বোধ যদি মনের গভীরে লালন করা যায় তাহলে মনের ভেতরকার হিংসা নামক অনন্ত আগুনের গোলাটি নিভে যাবে। প্রশান্ত হয়ে উঠবে মন। শান্তিতে ভরে উঠবে জীবন। তাই হিংসা নয়,আল্লাহর বণ্টন ব্যবস্থার ওপর সন্তুষ্ট থাকাই আমাদের কর্তব্য।

 

এখানে আরেকটি কথা বলে রাখা উচিত,তাহলো আল্লাহ কিন্তু বলেন নি যে ধন-সম্পদের মালিক হওয়া যাবে না। মানুষ তার নিজের শ্রম দিয়ে পরিশ্রম দিয়ে নিজের ভাগ্য নিজে গড়তে পারে। বরং যারাই নিজের ভাগ্য গড়ার কাজে আত্মনিয়োজিত হবে,সচেষ্ট হবে আল্লাহ তাদের সাহায্য করবেন।তাই পরিশ্রমের মাধ্যমে সম্পদশালী হবার মধ্যে কোনোরকম দোষ নেই,বাধানিষেধও নেই। মনে রাখতে হবে নানা কারণে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে। বহু ধনী মানুষ নানা কারণে গরীব হয়ে পড়ে। আবার গরীব মানুষও চেষ্টার মাধ্যমে ধনসম্পদের মালিক হয়। তাই অপরের ধন-সম্পদ দেখে হিংসায় জ্বলেপুড়ে না মরে নিজের উন্নতির জন্যে চেষ্টা চালানোই সঙ্গত। তাতে আল্লাহও খুশি হন। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী পরিশ্রমী লোকের শ্রমটাও ইবাদাততূল্য।

 

যেখানে রমযান মাসের রোযা বিগত দিনের পাপগুলোকে মুছে ফেলে, সেখানে যদি হিংসা বা পরশ্রীকাতরতার মতো একটা অসৎ গুণ পাপের পরিবর্তে পুণ্যগুলোকেই নষ্ট করে দেয় তাহলে এর চেয়ে আর দুর্ভাগ্য কী হতে পারে! তাই মনটাকে কলুষমুক্ত করতে হবে। মনের ভেতর হিংসা-বিদ্বেষ পুষে রাখা ঠিক নয়। রমযানে তো নয়ই,রমযান মাসের বাইরেও এইসব নিকৃষ্ট বিষয়ের চর্চা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবেই রমযান হয়ে উঠবে আমাদের জন্যে রহমতের বসন্ত ঋতু। আল্লাহ আমাদেরকে এই ঋতু অর্থাৎ রমযানের ঐশী কল্যাণগুলো থেকে উপকৃত হবার তৌফিক দিন। সবশেষে সপ্তম রোযার দোয়া দিয়ে শেষ করবো আজকের আসর।

লেখক সম্পর্কে

administrator

মতামত জানান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.