তাফসীর

ঐশী আতিথ্যের মাস-রমজান : ২০১৩ (৯ পর্ব)

আত্ম-গর্ব বা আত্মম্ভরিতা বা হামবড়াই নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করব। আলোচনার শুরুতেই পবিত্র কোরআনের সুরা কাহফের ১০৩ এবং ১০৪ আয়াতের দিকে একবার নজর দেই । এই দুই আয়াতে বলা হয়েছে, “বলুন! আমি কি তোমাদেরকে সেসব লোকের সংবাদ দেব, যারা কর্মের দিক দিয়ে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত। তারাই সে লোক, যাদের প্রচেষ্টা পার্থিব জীবনে বিভ্রান্ত হয়, অথচ তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করেছে।”
অন্যদিকে হজরত আলী (আ) বলেছেন, যার হৃদয়ে একবার আত্মম্ভরিতা বা আত্মগর্ব প্রবেশ করেছে তার ধ্বংস অনিবার্য।

মনোজগতের মারাত্মক এক ব্যাধি আত্মম্ভরিতা বা হামবড়াই বা আত্মগর্বের বিপদের কথা আমরা জানতে পারলাম। অন্য অনেক উপসর্গের মত এরও নানা প্রকারভেদ আছে। এবার এর প্রকারভেদের দিকে নজর দেই। ইমাম মূসা আল কাজেম (আ) বলেছেন, আত্মম্ভরিতা কয়েক প্রকারের। এর মধ্যে একটি হলো, কারো কাছে নিজের বদ বা খারাপ কাজগুলোও সৎ কর্ম হিসেবে প্রতিভাত হতে থাকে এবং তিনি সে সব কাজকে সৎ কর্ম হিসেবে মনে করতে থাকেন, এবং নিজে

আত্ম-গর্ব বা আত্মম্ভরিতা বা হামবড়াই নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করব। আলোচনার শুরুতেই পবিত্র কোরআনের সুরা কাহফের ১০৩ এবং ১০৪ আয়াতের দিকে একবার নজর দেই । এই দুই আয়াতে বলা হয়েছে, “বলুন! আমি কি তোমাদেরকে সেসব লোকের সংবাদ দেব, যারা কর্মের দিক দিয়ে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত। তারাই সে লোক, যাদের প্রচেষ্টা পার্থিব জীবনে বিভ্রান্ত হয়, অথচ তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করেছে।”
অন্যদিকে হজরত আলী (আ) বলেছেন, যার হৃদয়ে একবার আত্মম্ভরিতা বা আত্মগর্ব প্রবেশ করেছে তার ধ্বংস অনিবার্য।

মনোজগতের মারাত্মক এক ব্যাধি আত্মম্ভরিতা বা হামবড়াই বা আত্মগর্বের বিপদের কথা আমরা জানতে পারলাম। অন্য অনেক উপসর্গের মত এরও নানা প্রকারভেদ আছে। এবার এর প্রকারভেদের দিকে নজর দেই। ইমাম মূসা আল কাজেম (আ) বলেছেন, আত্মম্ভরিতা কয়েক প্রকারের। এর মধ্যে একটি হলো, কারো কাছে নিজের বদ বা খারাপ কাজগুলোও সৎ কর্ম হিসেবে প্রতিভাত হতে থাকে এবং তিনি সে সব কাজকে সৎ কর্ম হিসেবে মনে করতে থাকেন, এবং নিজে ভাল কাজ বা সৎ-কর্ম করছেন বলে ধরে নেন। এ ছাড়া আত্মগর্বের আরেকটি প্রকার হলো, কেউ কেউ মনে করেন ঈমান এনে আল্লাহর প্রতি আনুকুল্য দেখান হয়েছে। নাউজুবিল্লাহ। অথচ বাস্তব সত্য হলো, অন্ত:করণে ঈমান আনার শক্তি এবং সামর্থ যুগিয়ে আল্লাহই প্রকৃতপক্ষে তাকে অপরিসীম দয়া করেছেন।

 

আত্মগর্ব বা আত্মম্ভরিতার আরেকটি প্রতিশব্দ হলো হামবড়াই । আত্মগর্বী ব্যক্তির কাছে নিজের সৎ গুণাবলী বড় হয়ে ভেসে উঠে। তিনি নিজেই নিজেকে বড় করে তোলেন। অর্থাৎ হামবড়াই করতে থাকেন। তিনি তার এই গুণাবলীর জন্য যারপরনাই সন্তোষ প্রকাশ করেন। একইভাবে তিনি নিজেকে সকল ধরণের ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত বলে ভাবতে শিখেন, নিজের সৎগুণের ব্যাপারে বেশ উৎফুল্লবোধ করেন এবং,প্রফুল্ল চিত্তে ভাবেন যে সৎকর্মে লিপ্ত রয়েছেন। নিজের মধ্যে আত্মগর্ব বা আত্মম্ভরিতা নেই তার বদলে সৎগুণরাজি আছে মনে করে তিনি বিনীত চিত্তে খোদার কাছে শোকরিয়াও জ্ঞাপন করেন। কারো কারো মনো জগতের এহেন পরিস্থিতি প্রতিই হয়ত ইঙ্গিত করে হজরত আলী (আ) বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজেকে খোদার দরবারে বড় বলে মনে করেন প্রকৃতপক্ষে তিনি একেবারেই মূল্যহীন ব্যক্তি মাত্র।

 

ইমাম জাফর আস সাদেক (আ) আত্মম্ভরিতা প্রসঙ্গে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, শয়তান বলে, আদম সন্তানদের যদি তিনটি ক্ষেত্রে পরাভূত করতে পারি তবে তারা যতই সৎ কর্ম করুক না কেনো তা নিয়ে আর আমি মাথা ঘামাই না, কারণ আমি নিশ্চিত ভাবে জানি তার ওই সব সৎ কর্ম আর গ্রহণ করা হবে না। এই তিনটি ক্ষেত্র হলো, ১. কেউ যদি নিজের সৎ কর্মকে বাড়িয়ে দেখতে শুরু করে, ২. কেউ যদি তার পাপ-তাপ, ভুল-ভ্রান্তির কথা ভুলে যায়, ৩. কারো মনে যদি আত্মগর্ব, আত্মম্ভরিতা বা হামবড়াই চেপে বসে।

 

একজন জ্ঞানী বা নিষ্ঠাবান মানুষের মনোজগতের গঠন কি রকম হওয়া বাঞ্চনীয়? বিশ্ব জগতের জন্য রহমত স্বরূপ হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, একজন জ্ঞানী ব্যক্তি অন্যের গুটিকয়েক ভাল কাজকে অফুরন্তর সৎকর্ম হিসেবে বিবেচনা করেন এবং নিজের অন্তহীন সুকর্মকে হাতে গোণা অল্প কয়েকটি সৎ কর্ম হিসেবে ধরে নেন।

 

আত্মম্ভরিতা একজন অতিশয় সাধারণ মানুষের সৎ গুণ এবং সৎ কর্মকে যেমন বিনষ্ট করতে পারে ঠিক একইভাবে একজন ধার্মিকের সৎ গুণ এবং সৎ কর্মকে সমভাবে বিনাশ করতে পারে। মানব আত্মাকে বিনাশ করার মতো যে সব বদ বা খারাপ গুণ দেখতে পাওয়া যায় তার মধ্যে আত্মগর্ব বা আত্মম্ভরিতার স্থান রয়েছে। মৃত্যুর পর এবং আলমে বারজাখে অবস্থান কালে আত্মম্ভর ব্যক্তিকে দুঃসহ একাকিত্বের মধ্যে কাটাতে হবে। আত্মম্ভরিতার কাঁধে ভর করে আরো মারাত্মক গুনাহের সূচনা হতে পারে, হতে পারে মারাত্মক কোনো পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ার মতো দুর্ভাগ্য জনক ঘটনা। কারো হৃদয়ে যদি একবার আত্মম্ভরিতার বীজ প্রবেশ করতে পারে তবে সাথে সাথেই তার সৎ কর্মের ইতি ঘটে। শেষ পর্যন্ত তেমন ব্যক্তির শেরেকের মতো মারাত্মক অপরাধে লিপ্ত হওয়ার মতো মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটতে পারে।

 

‘বুঝলেই পাগল সারে’ বলে একটা কথা অনেকেই বলে থাকেন। এ কথার মর্মাথ হলো পাগল যদি বুঝতে পারে যে পাগলামী করছে তা হলে সাথে সাথেই পাগলামী বন্ধ করে দেবে। আত্মম্ভরিতার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। কারণ আত্মম্ভর ব্যক্তি কখনোই বুঝতে পারেন না যে তিনি আত্মম্ভরিতা করছেন। কাজেই তিনি নিজেকে শোধরানোর প্রয়োজন আছে বলেই মনে করেন না। তিনি তার অপরাধ বা গোনাহকে ছোট বলে হিসেব করতে থাকেন আর এ ভাবেই তিনি ধ্বংসের পথে ধাবিত হতে থাকেন। আত্মম্ভরিতার কৃষ্ণ পর্দায় তার অন্ত:করণ, তার জ্ঞান-বুদ্ধি, মেধা এবং মনন আগাগোড়া আবৃত হয়ে পড়ে। তিনি আর নিজের কোনো নিচতা বা ক্ষুদ্রতা কিংবা পাপাচার দেখতে পান না। আর এভাবে তিনি কামেল হওয়ার পথ থেকে হারিয়ে যান। তিনি আর পূর্ণতা অর্জন করতে পারেন না।

 

আত্মম্ভরিতার রাস্তা ধরেই আসে রিয়া বা প্রদর্শন বাতিকতা, নিফাক বা কপটতা। একই সাথে গর্ব উদ্ধত করে তুলে আত্মম্ভর ব্যক্তিকে। এই যখন হয় মনোজগতের অবস্থা তখন অন্যের প্রতি তিনি ঘৃণা প্রদর্শন করেন। অন্যকে তুচ্ছ বলে মনে করতে থাকেন। তিনি মানবিক মূল্যবোধের পথ থেকে সরে যেতে থাকেন ধীরে ধীরে, নিষ্ঠুর হয়ে উঠেন, হয়ে উঠেন হৃদয়হীন এবং তিনি ভয়াবহ ভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন, তার ঠিকানা হয়ে দাঁড়ায় ধ্বংস। হজরত আলী (আ) বলেছেন, আত্মম্ভরিতা থেকে যে একাকিত্বের সৃষ্টি হয় তার মত ভয়াবহ আর কিছু নেই। তিনি আরো বলেছেন, আত্মম্ভর ব্যক্তির মেধা বা মনন বলে কিছুই নেই। আত্মম্ভরিতাকে তিনি মুর্খতার ভিত্তিফলক বলে অভিহিত করেছেন।

 

আত্মম্ভরিতা থেকে বাঁচতে বা রক্ষা পেতে হলে কি করতে হবে? হ্যাঁ, এবার আমরা সে প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা করব। প্রথমেই নিজেকে চমৎকার আত্ম বিশ্লেষক হতে হবে। নিজের প্রতি পক্ষপাতহীনভাবে অর্থাৎ নির্মোহ দৃষ্টিপাত করতে হবে। নিজ কর্ম-তৎপরতা,উদ্দেশ্য সহ সব কিছু আবেগবিহীন ভাবে ভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। একই সাথে খোদার দয়া চাইতে হবে। খোদা যেনো তাকে নিজ দুর্বলতা সর্ম্পকে অবহিত হওয়ার সুযোগ দান করেন তা একান্ত ভাবে কামনা করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, খোদা যখন কেউকে তার অপার রহমতের ধারায় পূর্ণ করে দিতে চান তখন তাকে নিজ দুর্বলতা, ভুল এবং ভ্রান্তি বোঝার ক্ষমতা দান করেন।

 

এ কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, যে জীবন, ক্ষমতা,জ্ঞান বা সাফল্য সবই হচ্ছে আল্লাহর অপরিসীম দয়ার কারণে। তার দয়া ও করুণার কারণেই সকল সৎকর্ম, নেক তৎপরতা, এবাদত বা উপাসনা সম্ভব হয়ে উঠছে। জীবনে নানা সুযোগ লাভ ঘটছে। তার ইঙ্গিত ছাড়া আমাদের কারো পক্ষেই কোনো ভাল কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে পৃথিবীর কোনো মানুষই তার প্রতি অর্পিত ইবাদতের দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। নবী-রসুল-ইমাম-আউলিয়াদের মর্মস্পর্শী দোয়া এবং আল্লাহর দরবারে পানা ও মাগফেরাত কামনা করে কান্নাকাটি এ কথার স্বাক্ষ্য বহন করে। তারা জানতেন জীবনের প্রতিটি মুর্হুত এবাদতের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করলেও আল্লাহর সীমাহীন দয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শেষ করা যাবে না। কাজেই তারা বিনম্র চিত্তে এবং সিক্ত হৃদয়ে আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করতেন কাজেই তাদের রাস্তা ধরে আমাদের সবাইকে পরম বিনম্র চিত্তে তার ক্ষমা ও মাগফেরাত কামনা করতে হবে।

আল্লাহর সীমাহীন বরকত, রহমত এবং মাগফেরাত লাভের মাস এই রমজান। আসুন আমরা আত্মগর্ব, হামবড়াই বা আত্মম্ভরিতার কৃষ্ণব্যাধি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আজ থেকে তার দরবারে নতজানু হই। কান্নায় ভেংগে পড়ি আমাদের পাপ মোচনের জন্য। ইমাম বাকের (আ) বলেছেন, আত্মগর্বের পথ আধ্যাত্মিকতা দ্বারা রুদ্ধ করে দিতে হবে।

লেখক সম্পর্কে

administrator

মতামত জানান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.