ইতিহাস ইতিহাস

‘ইমাম হুসাইনের (আ.) জন্য যদি হাজার বার নিহত হতাম!’

নূর বার্তা সংস্থা: ইমাম হুসাইন (আঃ)’র জীবনের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল শাহাদত। কারণ, রাসুলে খোদা স্বয়ং বলেছেন, শাহাদাত হচ্ছে সবচেয়ে বড় পুণ্য। মনে পড়ে গেল তাঁর মহান পিতার শাহাদতের সময়কার কথাটি, সেটি হলো, কাবার প্রভুর কসম আমি সফল হয়েছি।

 

আবনা ডেস্কঃ আজ মহান তাসুয়া বা আশুরার পূর্ব দিন। ১৩৭৯ বছর আগে এই দিনে অর্থাৎ ৬১ হিজরির নয়ই মহররম কুফায় ইয়াজিদের নিযুক্ত কুখ্যাত গভর্নর ইবনে জিয়াদ ইমাম হুসাইন (আ.)’র ছোট্ট শিবিরের ওপর অবরোধ জোরদারের ও হামলার নির্দেশ দেয়।

এর আগেই আরোপ করা হয়েছিল অমানবিক পানি-অবরোধ। পশু-পাখী ও অন্য সবার জন্য ফোরাতের পানি ব্যবহার বৈধ হলেও এ অবরোধের কারণে কেবল নবী-পরিবারের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় এই নদীর পানি।ইয়াজিদ বাহিনীর সেনা সংখ্যাও ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং দশই মহররমের দিনে তা প্রায় বিশ বা ত্রিশ হাজারে উন্নীত হয়।

একই দিনে অর্থাৎ নয়ই মহররম কুফায় ইয়াজিদের নিযুক্ত কুখ্যাত গভর্নর ইবনে জিয়াদের নির্দেশে শিমার কারবালায় আসে। শিমার জিয়াদের একটি চিঠি হস্তান্তর করে তাদের সেনাপতি ওমর ইবনে সাদের কাছে। ওই চিঠিতে ইমাম হুসাইন (আ.)’র ছোট্ট শিবিরের ওপর অবরোধ জোরদারের ও হামলার নির্দেশ দেয়া হয়। ইয়াজিদপন্থী সেনা সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে কারবালায়।

ফলে ইমামের শিবির ঘেরাও করে ফেলে ইয়াজিদ সেনারা। ইবনে জিয়াদ ও ওমর ইবনে সাদ তাদের সেনা সংখ্যার আধিক্য দেখে নিশ্চিত হয় যে সম্ভাব্য যুদ্ধে ইমাম হুসাইন (আ.)ই পরাজিত হবেন এবং নানা ধরনের বাধা-বিপত্তির পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ইরাকিরা বা অন্য কেউই ইমামকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না। ( কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে দূরবর্তী কোনো কোনো অঞ্চল থেকে ইমাম ও আহলে বাইতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বা কয়েক শত সমর্থক যখন অবরূদ্ধ ইমাম আ. এবং তাঁর পরিবার ও সঙ্গীদেরকে সাহায্যের জন্য কারবালার কাছাকাছি পৌঁছেন ততক্ষণে ঘটে যায় আশুরার মহাট্র্যাজেডি বা বিয়োগান্তক ঘটনা।)

শিমার সৌন্দর্যের জন্য বনু হাশিমের চাঁদ নামে খ্যাত আবুল ফজল আব্বাস ও তাঁর ভাইদেরকে ইয়াজিদ সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার গ্যারান্টিসূচক একটি কার্ড দিতে চেয়েছিল এই শর্তে যে তাঁরা ইমামের (আ.) পক্ষ ত্যাগ করবেন। কিন্তু বীরত্ব ও ইমামের প্রতি আনুগত্যের জন্য খ্যাত হযরত আব্বাস (আ.) তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেছিলেন: তোমার ওপর ও তোমার আমিরের ওপর এবং নিরাপত্তা কার্ডের ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক। তুমি আমাদেরকে নিরাপত্তা দিতে চাইছ অথচ আল্লাহর রাসূল (সা.)’র পুত্রকে নিরাপত্তা দিচ্ছ না।

ইমাম হুসাইন (আ.) নয়ই মহররমের বিকালের দিকে এক দিনের জন্য যুদ্ধ পিছিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেন যাতে দশই মহররমের রাতটি শেষবারের মত ইবাদত বন্দেগিতে কাটানো যায়। ইয়াজিদ বাহিনীর প্রধান প্রথমে রাজি না হলেও পরে এ প্রস্তাবে রাজি হয়। বিকালেই হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) নিজ সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন। সঙ্গীরা আবারও তাঁর প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করেন।

নয়ই মহররম কালজয়ী কারবালা বিপ্লবের চূড়ান্ত প্রস্তুতি ও পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার দিন। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি অর্জনের সর্বশেষ দিন। এই পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর প্রায় ১০০ জন সহযোগী। আর এ জন্যই তাঁরা ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন।

 

আশুরার রাত

ইমাম হুসাইন (আঃ)’র জীবনের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল শাহাদত। কারণ, রাসুলে খোদা স্বয়ং বলেছেন, শাহাদাত হচ্ছে সবচেয়ে বড় পুণ্য। মনে পড়ে গেল তাঁর মহান পিতার শাহাদতের সময়কার কথাটি, সেটি হলো, কাবার প্রভুর কসম আমি সফল হয়েছি। তিনি বলেছিলেন খোদার কসম , অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুই ঘটেনি। মনে পড়ে গেল নানাজী রাসূল (সা.)’র কথা। তিনি আধ্যাত্মিক জগতে তাঁর উচ্চ মর্যাদার সুসংবাদ তাঁকে দিয়েছিলেন।

এসব ভাবতে ভাবতে তাঁর ক্লান্ত অবসন্ন চোখে তন্দ্রা চলে এলো। স্বপ্নে দেখলেন নানাজান রাসুলে খোদাকে, পিতা হযরত আলীকে, স্নেহময়ী মা ফাতিমাকে, আর ভাই ইমাম হাসানকে (তাদের সবার ওপর মহান আল্লাহর অশেষ রহমত ও দরুদ বর্ষিত হোক)। তাঁরা বললেন, হে হুসাইন! তুমি আগামীকালই আমাদের সাথে মিলিত হবে। এর পরপরই তার তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল। ইমাম (আঃ) তাঁর বোন বিবি জাইনাবকে স্বপ্নের কথা খুলে বললেন। ভাইয়ের নিশ্চিত শাহাদাতের কথা শুনে বোনের মন কি আর মানে ? বোন চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। ইমাম তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন।

ইমাম (আঃ) পরদিনের মহাকুরবানির জন্য প্রস্তুত হলেন। এই কুরবানি হবে সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এতে তিল পরিমাণ খাঁদ থাকতে পারবে না। কারণ, আগামীকাল যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হবেন তাঁদের প্রতিটি রক্ত বিন্দু শত সহস্র রক্ত বিন্দুতে নয় বরং লক্ষ-কোটি রক্ত বিন্দুতে পরিণত হয়ে সমাজ-দেহে সঞ্চালিত হবে। শহীদের খুন রক্তশূণ্যতায় আক্রান্ত সমাজ-দেহে নতুন রক্ত প্রবাহ দান করে। তাঁদের ব্যক্তিত্ব ও স্মৃতি যুগযুগ ধরে মানুষকে মুক্তির প্রেরণা যোগায়। তাদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস ও চেতনা দান করে। শহীদরা কিয়ামত পর্যন্ত অমর থাকবেন এবং শেষ বিচারের দিন আল্লাহ তাঁদেরকে এমন জৌলুসসহ হাজির করবেন যে স্বর্গীয় বাহনে উপবিষ্ট নবী-রাসূলরাও তাঁদেরকে সম্মান দেখানোর জন্য নীচে অবতরণ করবেন।

তাই ইমাম তাঁর কাফেলার মধ্যে যাদের নিয়্যতে বিন্দু পরিমাণ গোলমাল আছে তাদের কাছ থেকে মুক্ত হতে চাইলেন। তিনি সবাইকে একস্থানে সমবেত করলেন এবং শাহাদাতের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় ভাষণ দিলেন। তিনি মহান আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন, “আমি আমার সঙ্গী সাথীদের চেয়ে কোন সাথীকে বেশি নেককার এবং আমার আহলে বাইতের চেয়ে কোন পরিবারকে বেশি উত্তম মনে করি না। মহান আল্লাহ তোমাদের সবাইকে উত্তম প্রতিদান দিন।”

ভয়াবহ আশুরার পূর্বাভাস নিয়ে ঘনিয়ে এলো অন্ধকার। ধৈর্য্যের মূর্ত প্রতীক ইমাম হুসাইন (আঃ) সকলকে কাছে ডাকলেন। বললেন, ভায়েরা আমার! জেনে রাখো আজকের এই রাত হবে তোমাদের শেষ রাত। আমার সাথে থাকলে তোমরা কেউ রেহাই পাবে না। আগামীকালই আমাকে ও আমার পরিবার পরিজনকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হবে। এমনকি আমার দুধের বাচ্চাকেও এরা রেহাই দেবে না। ভাইসব, “তোমরা ইচ্ছে করলে চলে যেতে পারো। আমার হাতে তোমরা যে বায়াত করেছো, তা আমি ফিরিয়ে নিলাম। তোমরা এখন মুক্ত। আমার জন্যে শুধু শুধু তোমরা কেন প্রাণ দেবে ? শত্রুরা শুধু আমাকে চায়, তোমাদেরকে নয়। এখন অন্ধকার রাত। যার ইচ্ছা চলে যাও, কেউ দেখতে পাবে না।” ইমাম ভাষণ শেষ করে তাঁর ভাই আব্বাসকে প্রদীপ নিভিয়ে দিতে বললেন।

কিন্তু আশুরার রাতে কেউই ইমামকে ত্যাগ করেননি বলে বেশিরভাগ ঐতিহাসিকরাই উল্লেখ করেছেন। অবশ্য বলা হয় ইমামের সঙ্গীদের সংখ্যা ছিল একশো জনেরও কম।

আত্মত্যাগের আদর্শে বলীয়ান বিশুদ্ধ অন্তরের এই মর্দে মুমিনদের দিকে তাকিয়ে ইমামের প্রশান্ত মুখটা উজ্জ্বল দীপ্তিমান হয়ে উঠল। মহাকালের মহাত্যাগের জন্যে এরকম বিশুদ্ধ হৃদয়গুলোই তাঁর প্রয়োজন ছিল। তবুও তিনি তাঁর সাথীদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কেন গেলে না? এ প্রশ্ন শুনে আহলে বাইতের সদস্যরা বলে উঠলেন, একি বলছেন হযরত! আমরা আপনাকে একা ফেলে কিভাবে চলে যাবো? লোকের কাছে গিয়ে কীভাবে মুখ দেখাবো? আমরা কি বলব মহানবী (সঃ) এর সন্তানকে আমরা একা ফেলে চলে এসেছি। তা কখনো হবে না। নিজের জীবন দিয়ে দেব তবুও আপনাকে ছেড়ে যাব না। আপনার সাথে থেকে শহীদ হব।

মুসলিম বিন আউসাজা দাঁড়িয়ে বললেন, প্রিয় ইমাম একি বলছেন আপনি! আপনাকে দুশমনদের হাতে ফেলে রেখে পালিয়ে যাবো? খোদা আপনার পরে যেন আমাদের জীবিত না রাখেন। আমরা যুদ্ধ করবো । গায়ে শক্তি থাকা পর্যন্ত দুশমনের গায়ে তলোয়ার চালাবো, বর্শা চালবো। ওগুলো ভেঙ্গে গেলে পাথর মেরে মেরে যুদ্ধ করবো।

সাঈদ বিন আবদুল্লাহ হানাফী বললেন, প্রিয় ইমাম ! খোদার কসম আপনাকে রেখে আমরা কোথাও যাবো না। আপনার জন্যে যদি নিহত হই ও জীবন্ত দগ্ধ হই এবং তা যদি ৭০ বারও হয় তবুও আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না। আপনি মরে যাবেন আর আমরা বেঁচে থাকব এ কি করে হয় ! যুহাইর ইবনে কাইন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, হে মহানবীর প্রিয় সন্তান, আপনি ও আপনার পরিবারকে রক্ষার জন্যে আমাকে যদি হাজার বারও মেরে ফেলা হয় তাহলেও আমি আপনাকে রক্ষার জন্য যুদ্ধ করব। অর্থাৎ আপনার জন্য আমার এ নগণ্য জীবনকে মাত্র একবার কুরবান করা খুবই তুচ্ছে! এভাবে ইমামের বিভিন্ন সঙ্গী সাথী ইমামকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন, নিজেদের আন্তরিকতা প্রকাশ করতে লাগলেন।

সঙ্গী-সাথীদের এরকম দৃঢ়তা দেখে ইমামের চেহারা মুবারক এক অভূতপূর্ব প্রফুল্লতায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালেন। ইমাম হুসাইন (আঃ)’র ভাষণের পর সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে মশগুল হলেন ইবাদতে। কেউ সিজদায়, কেউ নামাজে, কেউ মুনাজাতে। কারবালার প্রান্তর সিক্ত হয়ে উঠল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহীদদের অশ্রুতে। দুনিয়ার সব ফেরেশতা যোগ দিলেন তাঁদের এই প্রার্থনায়।

লেখক সম্পর্কে

Admin

মতামত জানান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.