নূর বার্তা সংস্থা: কুরআনের আলো অনুষ্ঠানের এই পর্বে সূরা আন-নমলের ৭৬ থেকে ৮১ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই সূরার ৭৬ থেকে ৭৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
إِنَّ هَذَا الْقُرْآَنَ يَقُصُّ عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ أَكْثَرَ الَّذِي هُمْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَ (76) وَإِنَّهُ لَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ (77) إِنَّ رَبَّكَ يَقْضِي بَيْنَهُمْ بِحُكْمِهِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْعَلِيمُ (78) فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّكَ عَلَى الْحَقِّ الْمُبِينِ (79)
“নিঃসন্দেহে এই কুরআন বনী ইসরাইলকে বেশিরভাগ এমন সব বিষয়ের (স্বরূপ) বর্ণনা করে সেগুলো নিয়ে তারা মতভেদ করে।” (২৭:৭৬)
“নিশ্চিতভাবে এটা হচ্ছে মুমিনদের জন্য পথ নির্দেশনা ও রহমত।” (২৭:৭৭)
“নিশ্চয় (এভাবে) তোমার রব তাদের মধ্যেও নিজের হুকুমের মাধ্যমে ফায়সালা করে দেবেন, তিনি পরাক্রমশালী ও সব কিছুই জানেন।” (২৭:৭৮)
“কাজেই হে নবী! আল্লাহর ওপর ভরসা করো, নিশ্চয় তুমি সুস্পষ্ট সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত আছ।” (২৭:৭৯)
আগের পর্বে ওই সব মুশরিক সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে, যারা কিয়ামতকে অস্বীকার করতো এবং কিয়ামত দিবসে পুনরুজ্জীবিত হওয়া ও শেষ বিচারের প্রতি বিশ্বাসকে নানা অজুহাতে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো। এ পর্বে এরইমধ্যে যেসব আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা জেনেছি সেগুলোতে ইহুদিদের সম্পর্কে বক্তব্য এসেছে। এসব আয়াতে ঐসব ইহুদির কথা বলা হয়েছে, যারা আরব উপদ্বীপে বসবাস করত এবং ইসলাম ধর্ম ও পবিত্র কুরআনকে মেনে নিতে রাজি হয়নি।
হজরত ঈসা (আ.) ও শেষ জামানার মুক্তির দূত সম্পর্কে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে ব্যাপক দ্বন্দ্ব ও বিরোধ ছিল। এছাড়া কিছু ধর্মীয় বিধান নিয়েও তাদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। এসব আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন: তারা যদি কুরআনকে আসমানি গ্রন্থ বলে মেনে নিত, তাহলে তাদের মধ্যকার বিরোধের অবসান হত। এছাড়া, হজরত ঈসা (আ.) এবং হজরত মুসা (আ.)’র পর ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের মধ্যে যেসব কুসংস্কার ঢুকে পড়েছে সেসবের অবসান ঘটতো। এর ফলে তারা একটি কুসংস্কারমুক্ত ও পরিশুদ্ধ ধর্ম পেত।
এরই ধারাবাহিকতায় আল্লাহতায়ালা রাসূল (সা.) ও মুমিনদের উদ্দেশে বলছেন: তোমরা অবশ্যই শত্রুর মোকাবিলায় আল্লাহর উপর ভরসা করবে। আল্লাহর অসীম জ্ঞান ও শক্তির ওপর নির্ভর করে তোমাদের পথে তোমরা এগিয়ে যাবে। জেনে রাখ, তোমরা সত্য পথে আছ। আর সত্যই টিকে থাকবে।
সূরা নমলের ৭৬, ৭৭, ৭৮ ও ৭৯ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. পবিত্র কুরআন ঐক্যের প্রতীক। এ মহাগ্রন্থ চিন্তাগত বিরোধ মেটাতেও সক্ষম। শুধুমাত্র মুসলমানরাই নয় অন্য ঐশী গ্রন্থগুলোর অনুসারীরাও কুরআনকে মেনে নিয়ে ও কুরআনের স্মরণাপন্ন হয়ে দ্বন্দ্ব-বিরোধ মেটাতে পারে।
২. হেদায়াত বা সঠিক ও সত্য পথপ্রাপ্তি হলো পরম করুণাময় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য একটি মহা নেয়ামত।
৩. আল্লাহর ওপর নির্ভরতা হচ্ছে মানুষের সফলতার একটি অন্যতম প্রধান শর্ত। এ নির্ভরতা হতে হবে ন্যায়ের ক্ষেত্রে। অন্যায়ের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়।
সূরা নমলের ৮০ ও ৮১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
إِنَّكَ لَا تُسْمِعُ الْمَوْتَى وَلَا تُسْمِعُ الصُّمَّ الدُّعَاءَ إِذا وَلَّوْا مُدْبِرِينَ (80) وَمَا أَنْتَ بِهَادِي الْعُمْيِ عَنْ ضَلَالَتِهِمْ إِنْ تُسْمِعُ إِلَّا مَنْ يُؤْمِنُ بِآَيَاتِنَا فَهُمْ مُسْلِمُونَ (81)
“মৃতকে তুমি তোমার আহবান শোনাতে পারো না এবং বধিরকেও কথা শোনাতে পারো না, যখন ওরা মুখ ফিরিয়ে নেয়।” (২৭:৮০)
“এবং অন্ধদেরকে পথ বাতলে দিয়ে বিপথগামী হওয়া থেকে বাঁচাতে পারোনা। তুমি কেবল নিজের কথা তাদেরকেই শোনাতে পারো যারা আমার আয়াতর প্রতি ঈমান আনে এবং তারপর অনুগত হয়ে যায়।” (২৭:৮১)
আগের আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে, পবিত্র কুরআন সৎ পথ প্রদর্শন করে। কিন্তু শক্ররা অন্ধভাবে কুরআনের বিরোধিতা করে। পবিত্র কুরআনের বার্তায় কোনো সমস্যা নেই। আসলে যারা হিংসা, অহংকার, জেদ ও কুসংস্কারে বিশ্বাস করে, তারা জীবিত অবস্থাতেও মৃত ব্যক্তির মতো। এ ধরনের মানুষের ওপর সত্যের বাণী কোনো প্রভাবই ফেলে না। একইসঙ্গে তারা এমন জীবিত ব্যক্তির মতো যারা সতর্ক বাণী শুনতে পায় না এবং নিজের অন্যায় পথচলা অব্যাহত রাখে। যেমনিভাবে একজন বধিরকে পেছন থেকে ডাকলেও সে শুনতে পায় না। একইভাবে কাফেররা সত্য পথ দেখেও দেখে না এবং সত্যের বাণী শুনেও তা উপলব্ধি করতে পারে না। তারা অন্ধ ও বধির।
যারা রাসূল (স.) ও কুরআনের মাধ্যমে হেদায়েতপ্রাপ্ত হতে চায়, অবশ্যই তাদেরকে সত্যের সামনে বিনয়ী ও নত হতে হবে। একইসঙ্গে পবিত্র কুরআনের উপর প্রকৃত ঈমান থাকতে হবে। অন্যভাবে বলা যায়, তারাই কুরআনের মাধ্যমে হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে যারা অন্তরের ও চিন্তাগত বাধা অতিক্রম করতে পারবে। ব্যক্তির পুরোনো চিন্তা-বিশ্বাস ও কুসংস্কার সত্য পথ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ।
যারা চিন্তাভাবনা না করে পূর্বপুরুষদেরকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে তারা সত্যের বাণী শোনার পরও সেটাকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে থাকে। আসলে নবী-রাসূলদের বার্তায় কোন সমস্যা নেই বরং জেদ ও হিংসার কারণে অনেক মানুষ সঠিক পথ খুজে পায় না। মানুষের যখন অন্তর মরে যায়, তখন সে সত্য গ্রহণ করতে পারে না। সত্যের বাণী কোন প্রভাব ফেলে না। যেমনিভাবে কোনো বাল্ব যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখন সে বাল্বে হাজার বার বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হলেও তাতে আলো জ্বলে না।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. কুরআনে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক-এ দুই ধরনের মৃত্যুর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যারা আল্লাহর আহবানে সাড়া দেয় না এবং কুরআনের বিরোধিতা করে তারা জীবিত অবস্থাতেও মৃত। যদিও বাহ্যিকভাবে তারা দুনিয়াতে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করে থাকে। অপরদিকে কুরআনের ভায়ায়, যারা আল্লাহর পথে শহীদ হন, তারা মৃত নন, বরং জীবিত এবং আল্লাহ তাদেরকে রিজিক দান করে থাকেন। যদিও দৃশ্যত তারা জীবিতদের মাঝে অনুপস্থিত।
২. শুধুমাত্র চোখ, কান, বিবেক থাকলেই হবে না। সত্যকে গ্রহণ করার অর্থাৎ আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পনের মানসিকতা থাকতে হবে। আর যদি এ ধরনের মানসিকতা না থাকে তাহলে মানুষ নিজের চোখে সত্যকে দেখে ও শুনেও তা মেনে নেয় না। এমনকি নিজের স্বাথ্যে সত্যকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে। আসলে যে ব্যক্তি ঘুমের ভান করে, তাকে হাজার বার ডেকেও ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব নয়।